Home Economics বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিতে চীনের উত্থান: বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?

বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিতে চীনের উত্থান: বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?

36
0

চট্টগ্রাম বন্দরের কুয়াশা ভেদ করে প্রতিদিন যেসব কনটেইনারবাহী ট্রাক ঢাকার দিকে দিকে ছুটে চলে, তার অনেকগুলোর ভেতরে থাকে ‘মেড ইন চায়না’ লেখা যন্ত্রাংশ, পোশাক, ইলেকট্রনিক-সামগ্রীসহ বিভিন্ন কাঁচামাল। অপরদিকে বন্দরের গেট পেরিয়ে চীনের উদ্দেশে যাত্রা করে চিংড়ি, চামড়া, জুটজাত পণ্য ও অন্যান্য রফতানিপণ্য ভরা কনটেইনার। এই যাওয়া-আসার গল্পটাই আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—নাম তার চীন। চীনের উত্থান কেবল বৈশ্বিক অর্থনীতিতেই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি প্রস্তুত এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে?

চীন শুধু বাণিজ্যে নয়, পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েগুলোতে এবং কর্ণফুলী টানেলসহ বড় অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা দিয়ে আসছে। চীনা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি বাংলাদেশকে শুধু অবকাঠামো নির্মাণে সাহায্য করছে না, বরং শিল্প উৎপাদন, রফতানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যেও নতুন গতি আনছে।

রফতানিতে চীনের অবদান

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের রফতানি খাতকে গতিশীল রাখতে যেসব কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, তার বেশিরভাগ আসে চীন থেকে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আগে মূলধনি যন্ত্রপাতি প্রধানত জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসতো। এখন সেই জায়গা দখল করেছে চীন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে চীনা কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়িয়েছে।”

বাংলাদেশের শিল্প উৎপাদন ও রফতানি সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চীনের ওপর নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। এটি দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে, যেখানে শুধু অর্থনৈতিক হিসাবই নয়, কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও চীনের প্রভাব স্পষ্ট।

চীনের সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল রফতানির সময়সীমা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে স্থানীয় উৎপাদকরা আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রুত প্রতিযোগিতা করতে পারছে। বিশেষ করে পোশাক, চামড়া, জুটজাত পণ্য ও ইলেকট্রনিক্স খাতের রফতানি কার্যক্রমে চীনের সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অবকাঠামো বিনিয়োগে চীনের প্রভাব

বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে অবকাঠামোগত প্রকল্পে। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক থেকে শুরু করে পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের আশপাশের উন্নয়ন, কিংবা এক্সপ্রেসওয়ে—সবখানেই রয়েছে চীনা কোম্পানির হাত রয়েছে।

চীনের সরকারি ঋণ ও বিনিয়োগ এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় উৎস। বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক করিডর (বিসিআইএম) এবং “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” (বিআরআই) এর আওতায় চীন বাংলাদেশের ৩০টিরও বেশি প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, বর্তমানে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি।

এই বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে শিল্পাঞ্চল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেলওয়ে, বন্দর সম্প্রসারণ ও টেলিকম অবকাঠামো।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে  বলেন, “চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের অবকাঠামো ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে ঋণের শর্ত ও প্রকল্পগুলোর টেকসইতা নিশ্চিত করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।”

টেলিকম খাতে চীনের প্রভাব

বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামোর বড় অংশ এখন চীনা প্রযুক্তিনির্ভর। মোবাইল নেটওয়ার্কের যন্ত্রাংশ, ফাইবার অপটিক, সিসিটিভি ক্যামেরা, এমনকি সরকারি তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পেও হুয়াওয়ে ও জেডটিই’র ভূমিকা বিশাল।

বাংলাদেশের টেলিকম কোম্পানিগুলোর (গ্রামীণফোন বাদে) প্রায় সবগুলোই চীনা সরঞ্জাম ব্যবহার করে। এ ছাড়াও সরকারি নিরাপত্তা অবকাঠামো, স্মার্ট সিটি প্রকল্প, এবং ডেটা সেন্টারে চীনা কোম্পানির প্রযুক্তি রয়েছে।

এখানে ভূ-রাজনৈতিক একটি বাস্তবতা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে ৫জি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ে বর্জন করছে, সেখানে বাংলাদেশ চীনা প্রযুক্তি গ্রহণে তুলনামূলক উন্মুক্ত।

বড় হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি: বাড়ছে সম্ভাবনা

চীন শুধু বিনিয়োগই নয়, প্রযুক্তিগত সহায়তার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে চীনা কোম্পানিগুলো সরাসরি কাজ করছে—বিশেষ করে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক, স্মার্ট ডেটা সেন্টার ও ক্লাউড প্রযুক্তিতে।

সরকারের “স্মার্ট বাংলাদেশ” উদ্যোগের সঙ্গে চীনা প্রযুক্তির মেলবন্ধন নতুন বাজার ও সেবা খাতের জন্ম দিচ্ছে।

উদাহরণস্বরূপ ই-কমার্স, মোবাইল পেমেন্ট, এআই-নির্ভর সাপ্লাই চেইন এবং ডিজিটাল কৃষি বাজার এখন দ্রুত প্রসার পাচ্ছে। এসবই বাজার অর্থনীতির নতুন জগত তৈরি করছে, যেখানে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন মূল্য নির্ধারণ ও প্রতিযোগিতাকে প্রভাবিত করছে।

বিনিয়োগে নতুন গতি

২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে চীনা বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় এক হাজার চীনা কোম্পানি দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে—গার্মেন্টস, নির্মাণ, বিদ্যুৎ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে।

চট্টগ্রাম ইপিজেডে চীনা মালিকানাধীন ডিরেকশন টেকনোলজি (বাংলাদেশ) লিমিটেড ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে হেডফোন ও ডেটা ক্যাবল উৎপাদন কারখানা স্থাপন করছে। এতে ৪৭৮ জন স্থানীয় কর্মী নতুন চাকরিতে যুক্ত হবে।

চায়না লেসো গ্রুপও প্রায় ৩২ কোটি ৭৭ লাখ ডলার বিনিয়োগে নতুন কারখানা স্থাপন করছে, যেখানে সৌর প্যানেল, পিভিসি পাইপ, স্যানিটারি-সামগ্রী ও নির্মাণ উপকরণ উৎপাদন হবে এবং ৫০০-৬০০ জন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) তথ্য অনুযায়ী, শুধু চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার চায়না ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে প্রায় ৩০টির বেশি চীনা কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে। বেজা সম্প্রতি চীনের বহুজাতিক শিল্প প্রতিষ্ঠান চায়না লেসো গ্রুপের কাছে ১২.৫ একর জমি হস্তান্তর করেছে।

চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ২০২৪ সালের শেষে প্রায় ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বেশি। গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিক্স, নির্মাণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো খাতে চীনা কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি দ্রুত বাড়ছে। বেপজার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ। চট্টগ্রাম ও মোংলা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় চীনা মালিকানাধীন বা যৌথভাবে পরিচালিত কারখানার সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলেও চীনা বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে টেক্সটাইল, প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক্স কারখানা। অনেক চীনা উদ্যোক্তা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন উৎপাদন হাব হিসেবে দেখছেন, কারণ এখানে শ্রমমূল্য তুলনামূলক কম।

চীনের সহায়তায় নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠছে ‘বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার’, যা দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখন কেবল বন্ধুত্বের নয়, বরং বাজার অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। চীনের পুঁজি ও প্রযুক্তি বাংলাদেশের শিল্প, অবকাঠামো এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নতুন গতি এনে দিচ্ছে। বন্দর, সড়ক, বিদ্যুৎ এবং ডিজিটাল সেবায় চীনা বিনিয়োগ দেশের বাজার কার্যকারিতা বাড়াচ্ছে।

রফতানি খাতেও বৈচিত্র্য দেখা দিচ্ছে। শুধু পোশাক নয়, এখন ওষুধ, চামড়া, কৃষিপণ্য ও ইলেকট্রনিক্স খাতেও বাংলাদেশের রফতানি বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। নতুন শিল্প ও সেবা খাতে লাখো কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। ডিজিটাল অর্থনীতি তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগের দ্বারও খুলছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারসাম্যপূর্ণ ও টেকসই অংশীদারত্বের মাধ্যমে আগামী দশকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উদীয়মান বাজার অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) চট্টগ্রামের আনোয়ারা, চাঁদপুর ও ভোলায় তিনটি চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। এদিকে চীন বাংলাদেশকে এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের পরবর্তী দুই বছরের শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি মনে করেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ৫০ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন আরও শক্ত ও কার্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই দেশের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নতুন সুযোগের দরজা খুলে দিচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, “চীন আমাদের অন্যতম বড় বিনিয়োগ অংশীদার। টানা ১৫ বছর ধরে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার চীনা কোম্পানি কাজ করছে।”

রোচি জানান, অবকাঠামো উন্নয়ন, তৈরি পোশাক, ওষুধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) ও ইলেকট্রনিক্স খাতে চীনা বিনিয়োগ এখন আরও বাড়ছে। “চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখে আমরা আশাবাদী যে এসব খাতে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে।’’

তিনি বলেন, “চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে ইতোমধ্যে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হয়েছে। এখন দ্বিতীয় অঞ্চল তৈরির কাজ চলছে। আমরা বিনিয়োগকারীদের জন্য কর ও অন্যান্য প্রণোদনায় বেশ আকর্ষণীয় সুযোগ দিচ্ছি।”

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয় প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এসবের মধ্যে রয়েছে মেশিনারি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, তুলা, রাসায়নিক এবং বিভিন্ন কাঁচামাল।

অপরদিকে, বাংলাদেশ চীনে রফতানি করেছে মাত্র ৭০০ মিলিয়ন ডলারের মতো পণ্য। অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতি এখনও ব্যাপক। তবে সরকারের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক দুই বছরে রফতানি কিছুটা বেড়েছে—বিশেষ করে পোশাক, ওষুধ, চামড়া ও কৃষিপণ্য খাতে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক কর্মকর্তা জানান, “চীন বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি রফতানি গন্তব্য নয়, বরং প্রযুক্তি, উৎপাদন ও উদ্ভাবনের এক বিশাল উৎস।”

বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাবেক মহাসচিব আল মামুন মৃধা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের রফতানিকারকরা তুলনামূলক কম দামে এবং স্বল্প সময়ে চীন থেকে সহজেই কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারছেন। এর ফলে তারা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলকভাবে পণ্য রফতানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন।’’

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের পণ্য সরাসরি চীনে রফতানি কম হলেও আমরা সারা পৃথিবীতে যে পণ্য রফতানি করি, তার বেশিরভাগের পেছনে চীনের অবদান উল্লেখযোগ্য। দেশের উদ্যোক্তারা চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করে তাতে মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে নানা দেশে রফতানি করছেন।”

আল মামুন মৃধা আরও বলেন, “বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক শিল্পের বিকাশেও চীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিল্পে ব্যবহৃত বেশিরভাগ যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আসে চীন থেকে। সুলভ মূল্যে এসব উপকরণ সরবরাহের কারণে আমরা শুধু নিজস্ব বাজারই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছি।”

জনমানসে চীনের প্রভাব

সেন্টার ফর অল্টারনেটিভস পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশের বেশি বাংলাদেশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। শিক্ষা ও চিকিৎসায় চীনের প্রতি আগ্রহও বেড়েছে—৭৫ শতাংশ উত্তরদাতা উচ্চশিক্ষার জন্য চীন বেছে নিতে আগ্রহী, আর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ২৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী চীনে যেতে ইচ্ছুক।

গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিল্পায়নে চীনের ভূমিকা এবং এর অরাজনৈতিক-কূটনৈতিক অবস্থান এই ইতিবাচক ধারণার প্রধান কারণ।

বাণিজ্য ও শিল্পে ভারসাম্য

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক গত এক দশকে বহুগুণে বেড়েছে। তবে এখনও এটি একপাক্ষিক। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশের রফতানি ছিল মাত্র ৭১৫ মিলিয়ন ডলার (মোট রফতানির ১.৬১ শতাংশ), বিপরীতে চীন থেকে আমদানি ছিল প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার— যা বাংলাদেশের মোট আমদানির এক-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে চীন থেকে আমদানি হয়েছে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য, যা দেশের মোট আমদানির প্রায় এক-চতুর্থাংশ। একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানি মাত্র ৮৫ কোটি ডলারের মতো। অর্থাৎ, বাণিজ্য ঘাটতি বিশাল— প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার।

তবে এ ঘাটতি কেবল নেতিবাচক নয়। চীন থেকে আসা পণ্যগুলোর বড় অংশই বাংলাদেশের উৎপাদন খাতের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য যে ফেব্রিক, সুতা, বোতাম, জিপার ইত্যাদি দরকার—তার বড় অংশই আসে চীন থেকে। ফলে আমদানি বাড়লেও তা দেশের শিল্প খাতকে সচল রাখছে।

বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানির তালিকা তুলনামূলক ছোট। তবু কিছু খাত ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে। বিশেষ করে সামুদ্রিক খাদ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুট এবং ফার্মাসিউটিক্যালস। ২০২০ সালে চীন বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ঘোষণা করার পর কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। তবু রফতানির পরিমাণ এখনও আমদানির তুলনায় সামান্য।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রফতানি ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশকে রফতানির পণ্যবৈচিত্র্য ও বাজার সম্প্রসারণে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে চীনের বাজারে তৈরি পোশাক, ওষুধ, পাটজাত পণ্য এবং হালকা প্রকৌশল সামগ্রী রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে, তবে তা কাজে লাগাতে সক্রিয় বাণিজ্য কূটনীতি প্রয়োজন।

প্রযুক্তি ও অবকাঠামো সহযোগিতা

চীনা প্রযুক্তি ও অর্থায়নে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হয়েছে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

ডিজিটাল অবকাঠামো ও টেলিকম খাত

হুয়াওয়ে, জেডটিই, ট্রান্সসিয়ন হোল্ডিংসের মতো চীনা কোম্পানির উপস্থিতি বাংলাদেশের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টি এখনও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। স্থানীয় শিল্পে চীনা প্রযুক্তির বাস্তব ব্যবহার ও জ্ঞান স্থানান্তর বাড়াতে যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ও কৌশলগত প্রভাব

২০১৬ সালে বাংলাদেশ বিআরআই-এ যুক্ত হওয়ার পর থেকে অবকাঠামো উন্নয়নে চীনা অর্থায়ন বেড়েছে বহুগুণে। বর্তমানে প্রায় ৪০টির বেশি প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন বা কারিগরি সহায়তা রয়েছে। বিআরআই প্রকল্পের আওতায় পদ্মা রেল সংযোগ, পায়রা ও মাতারবাড়ি বন্দর, কর্ণফুলী টানেল এবং বিভিন্ন সড়ক ও জ্বালানি প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন রয়েছে।

এসব প্রকল্প বাংলাদেশের উৎপাদন, লজিস্টিকস ও রফতানি সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।

দেশের অর্থনীতিবিদদের মতে, এসব অবকাঠামো শুধু বাণিজ্য সহজ করছে না, বরং স্থানীয় বাজার অর্থনীতিকেও প্রতিযোগিতামূলক করছে। তারা বলছেন, “যেখানে আগে শিল্পাঞ্চলগুলো শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল, এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে।”

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও ঋণ টেকসইতা গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাংলাদেশের উন্নয়ন কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তবে অতিরিক্ত ঋণনির্ভর প্রকল্প অর্থনৈতিক ভারসাম্যে চাপ তৈরি করতে পারে।

ঋণনির্ভর উন্নয়ন: আশীর্বাদ নাকি উদ্বেগ?

চীনা ঋণ নিয়ে বাংলাদেশে মতভেদ আছে। সরকার বলছে, এসব প্রকল্প দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ মনে করেন, অতিরিক্ত ঋণ-নির্ভরতা ভবিষ্যতে চাপ তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে চীনের অংশ প্রায় ৬-৭ শতাংশ। যদিও এটি শ্রীলঙ্কার মতো উচ্চ নয়, তবু অনেক প্রকল্পে চীনের ঋণ ও ঠিকাদার একসঙ্গেই যুক্ত। এতে প্রতিযোগিতা কমে যায় এবং ব্যয় বাড়ে—এমন অভিযোগও রয়েছে।

২০২৪ সালের আইএমএফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশের বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা বাড়াতে এবং অর্থনৈতিক বহুমুখিতা আনতে হলে ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা জরুরি।”

কূটনৈতিক ভারসাম্য

চীনের প্রভাব শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিতেও বাড়ছে। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় রফতানি বাজার ধরে রাখতে হবে, আর চীনের বিনিয়োগও বজায় রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন এখন শুধু বিনিয়োগকারী নয়, ‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার’ বটে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন এক গতি লক্ষ করা যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

সম্পর্কের নতুন অধ্যায়

চলতি বছরের মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস চীনে সরকারি সফরে যান। আলোচনায় ছিল বাণিজ্য ভারসাম্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও ঋণ পুনর্গঠন। চীন বাংলাদেশকে সবুজ জ্বালানি ও শিল্পাঞ্চল উন্নয়নে সহযোগিতা আশ্বাস দেয়। তিন মাস পর জুনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিনিধিরা চীন সফর করে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতৃত্বে দলীয় প্রতিনিধি দল চীনে যায়। আলোচনায় উঠে আসে উন্নয়ন অভিজ্ঞতা বিনিময়, রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও বিনিয়োগ সহযোগিতা।

পরের মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে জামায়াতে ইসলামী প্রতিনিধি দল চীন সফর করে। তারা চীনা থিঙ্কট্যাঙ্কের সঙ্গে বৈঠক করে ইসলামী অর্থনীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব সফর বাংলাদেশের ‘বহুমুখী কূটনীতি’ নীতিরই প্রতিফলন। পশ্চিমা চাপের বিপরীতে চীনের অ-হস্তক্ষেপমূলক সহযোগিতা ঢাকার কাছে কার্যকর বিকল্প। চীনও বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে বাংলাদেশের অবস্থান কৌশলগতভাবে দেখছে।

অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার

বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বাংলাদেশকেও নতুনভাবে ভাবাচ্ছে। বিশেষ করে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও প্রযুক্তি সহযোগিতার ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা স্পষ্ট। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় বাংলাদেশ এখন চীনের অন্যতম কৌশলগত অংশীদার।

চীনা বিনিয়োগ প্রবাহ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে, তবে একইসঙ্গে তৈরি হয়েছে নির্ভরতার নতুন প্রশ্নও।

বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?

চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ—এই দুইয়ের সমন্বয় প্রয়োজন। রফতানি ঘাটতি, প্রযুক্তি-নির্ভরতা ও ঋণ টেকসইতা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে দক্ষ জনবল, নীতিগত স্বচ্ছতা এবং শিল্প-বান্ধব অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই সম্পর্ক থেকে সর্বোচ্চ সুফল পেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী পাঁচ বছরে যদি বাংলাদেশ বিনিয়োগ পরিবেশ আরও স্থিতিশীল করতে পারে, তবে চীনা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সহযোগিতা দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

চীনের উত্থান কেবল বৈশ্বিক অর্থনীতিতেই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি প্রস্তুত এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে? যদি সুশাসন, স্বচ্ছতা ও দক্ষ পরিকল্পনা নিশ্চিত করা যায়, তবে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব হতে পারে বাংলাদেশের পরবর্তী প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here